সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২, ১২:৪৬ এএম
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অগ্রযাত্রা নিয়েও ইতিবাচক কথা হচ্ছে। দলের খেলোয়াড়দের আর্থিক দৈন্যও এসেছে সামনে। এ-তো গেল ঢাকার বাইরে নারী খেলোয়াড়দের পিছিয়ে পড়বার খবর। খোদ রাজধানী ঢাকায়ও নারীদের নেই খেলাধুলার মাঠের সেরকম কোনো ব্যবস্থা। এই নগরীতে দুই কোটির বেশি মানুষের বাস। অথচ বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ২১টি খেলার মাঠ। এরমধ্যে একটি মাঠ শুধু বরাদ্দ আছে নারীদের জন্য!
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, নারীরা খেলার মাঠ নিয়ে বৈষম্য শিকার হলেও সে ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনাও নেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্টদের। তারা স্পষ্ট বলছেন, নারীদের জন্য আলাদা খেলার মাঠ করা সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কয়েকটি খেলার মাঠে নারীদের জন্য আলাদা কর্নার রাখা হয়েছে। সেখানে নারীরা শুধু হাঁটতে পারেন।
সিটি করপোরেশনের সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী প্রত্যেক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ থাকতে হবে। সেই অনুযায়ী ঢাকা দুই সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডে মাত্র ২১টি খেলার মাঠ আছে। এরমধ্যে দক্ষিণে ১৩টি এবং উত্তরে ৮টি খেলার মাঠ। তবে এসব মাঠের মধ্যে মাত্র একটি মাঠ নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
যদিও ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, কমলাপুর খেলার মাঠ নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে ডিএনসিসি এলাকায় নারীদের জন্য কোনো খেলার মাঠ নেই।
সরেজমিন কমলাপুর ও শ্যামলী খেলার খেলার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা নারী ফুটবল খেলোয়াড়দের একমাত্র ভরসা ডিএসসিসির কমলাপুর খেলার মাঠ। গ্রাম-গঞ্জের মাঠের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কমলাপুর মাঠে এসে যেন প্রাণ ফিরে পান নারী খেলোয়াড়রা। কারণ মাঠের চারপাশে বাউন্ডারি, বাইরে থেকে সহজে খেলা দেখার সুযোগ নেই। আর এ মাঠেই প্রস্তুতি নিয়ে নারী ফুটবল খেলোয়াড়রা দেশ-বিদেশে পারি জমান। তাদের কাছে ডিএসসিসির এই মাঠ ছাড়া আর কোনো খেলার মাঠ নেই। অন্যদিকে ডিএনসিসির শ্যামলী মাঠে নারীদের হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে করা হয়েছে। শ্যামলী মাঠের মতোই রাজধানীর অধিকাংশ মাঠের চিত্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তানদের স্বস্তি দিতে উন্মুক্ত স্থানের বিকল্প নেই। সেজন্য ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য খেলার মাঠ পর্যাপ্ত থাকতে হবে। মেয়েদের খেলার সুযোগ করে দিতে না পারলে তাঁদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের মাস্টারপ্ল্যানে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা মাঠের ব্যবস্থা রাখা দরকার। কারণ ছেলেরা যে মাঠে খেলেন সেখানে মেয়েরা খেলতে অস্বস্তিবোধ করবে। নগরের পরিকল্পনায় দুই সিটি করপোরেশন নতুন মাঠের দিকে নজর দিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে গ্রামের তুলনায় শহরে জনঘনত্ব বেশি। প্রত্যেকটি শহরে একজন মানুষের জন্য কমপক্ষে নয় বর্গমিটার খোলা জায়গা দরকার। এই খোলা জায়গা হওয়া উচিত খেলার মাঠ ও পার্ক। সেখানে ঢাকা শহরে ব্যক্তিভেদে মাত্র এক বর্গমিটারেরও কম খোলা জায়গা রয়েছে। রাজধানীতে জনসংখ্যা বাড়ায় খেলার মাঠ ও পার্ক উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
শ্যামলীর বাসিন্দা শরিফা নাজনীন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা কোনো মাঠ নেই। বাধ্য হয়ে আমাদের শ্যামলী মাঠে আসতে হচ্ছে। এখানে এসে বিভিন্ন সময়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কারণ সকাল-বিকাল নারী ও পুরুষ একসাথে হাঁটতে গিয়েও গায়ে গায়ে লেগে যায়! যেখানে স্বস্তি নিয়ে হাঁটা যায় না, সেখানে নারীরা কীভাবে খেলাধুলা করবেন? নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা বলা হয়— কোথায় সেই ব্যবস্থা!
রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত গুলশানেও নারীদের জন্য কোনো মাঠ ও পার্ক নেই। গুলশান-২ এর বাসিন্দা সমীরণ বেগম বললেন, প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে গুলশান লেক ছাড়া হাঁটাহাটির বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। আমার ১০ বছরের একটি মেয়ে আছে, বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে শরীরের ওজন বেড়েছে। তাঁকে লেকে হাঁটার কথা বললে, আসতে চায় না। বাচ্চারা সারা দিন বাসায় থাকলে হাঁপিয়ে ওঠে। সেজন্য নারীদের আলাদা খেলার মাঠ ও পার্ক থাকা জরুরি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) সিরাজুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বললেন, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে যেসব নারী খেলোয়াড় রয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ডিএসসিসির কমলাপুর মাঠে খেলেছেন। এই মাঠ শুধু নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামীতে মাঠটি আরও কীভাবে যুযোগযোগী করা যায়, সেটি নিয়ে পরিকল্পনা চলছে।
ডিএসসিসির মাস্টারপ্ল্যানে নারীদের জন্য আলাদা মাঠ বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে কিনা— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, জনঘনত্বের তুলনায় ঢাকায় মাঠ ও পার্কের জায়গা সংকট আছে। মাস্টারপ্ল্যানে নারী খেলোয়াড়দের আলাদা করে তাই খেলার মাঠ বরাদ্দ রাখা সম্ভব নয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মকবুল হোসেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, নারী খেলোয়াড়দের জন্য ডিএনসিসি আলাদা মাঠ ও পার্ক নেই। তবে বেশকিছু মাঠে নারীদের জন্য আলাদা কর্নার রয়েছে। সেখানে নারীরা হাঁটতে পারেন।
উদ্বেগজনক বিষয় নারীদের কোনো খেলার মাঠ নেই। স্কুল ও পাড়া-মহল্লায় মাঠে নারীদের হাঁটাহাটি করার জন্য মাত্র ৭% জায়গা রয়েছে। এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, নারী ও পুরুষ একই মাঠে খেলবেন এমন পরিবেশ আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। সেজন্য উভয়ের জন্যই বয়সভিত্তিক খেলার মাঠ তৈরি করা জরুরি। প্রতিটি ওয়ার্ডে মেয়েদের জন্য কমপক্ষে একটি খেলার মাঠ থাকা দরকার। সেজন্য সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের মাঠকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে যেসব নারী ফুটবলার রয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের বাড়ি ঢাকার বাইরে। বিভিন্ন জেলা থেকে উঠে এসেছেন তাঁরা। সাতক্ষীরা থেকে উঠে এসেছেন সাবিনা খাতুন। একই জেলা থেকে উঠে এসেছেন মাসুদা পারভীন। খাগড়াছড়ি থেকে মনিকা চকমা, সিরাজগঞ্জ থেকে আঁখি খাতুন, টাঙ্গাইল থেকে কৃষ্ণা রানী সরকার, রংপুর থেকে সিরাত জাহান স্বপ্না, রাঙ্গামাটি থেকে রূপনা চাকমা, রিতুপর্না চাকমা ও নিলুফা ইয়াসমিন এসেছেন। এছাড়াও শিরোপাজয়ী এই দলের অধিকাংশ ফুটবলার উঠে এসেছেন ময়মনসিংহের কলসিন্দুর থেকে। এরা হচ্ছেন: শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্ডা, তহুরা খাতুন।