পেপসি, কোকাকোলা কি আসলেই ইসরাইলি পণ্য?

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী

অক্টোবর ২৭, ২০২৩, ০৬:০৪ পিএম

পেপসি, কোকাকোলা কি আসলেই ইসরাইলি পণ্য?

‘পেপসি, কোকাকোলা ইসরাইলি পণ্য, তাই এগুলো বয়কট করা উচিৎ’ - সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই এই ধরনের পোস্ট দেখা যায়। সেই সাথে ইউনিলিভারের পণ্য, বাটাসহ বেশ কয়েকটি পণ্য ইসরাইলের বলে বর্জনের কথা মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। আসলেই কি তাই?

কোনো ধরনের নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠানের পণ্যের নাম যুক্ত করে উক্ত তালিকাটি তৈরির মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। এমনও অনেক প্রতিষ্ঠান কিংবা পণ্যের নাম রয়েছে যেগুলো ইসরাইল রাষ্ট্র কিংবা ধারণা প্রতিষ্ঠারও অনেক আগে স্থাপিত হয়েছিল।

হামাস- ইসরাইলের যুদ্ধের নৃশংসতার প্রতিবাদ জানাতে ১৫টি ক্যাটাগরির ৩৩টি পণ্যের একটি তালিকা প্রচার হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ১৫ টি ক্যাটাগরির এই তালিকায় যেসব পণ্য রয়েছে, সেগুলো হলো: জুতার মধ্যে বাটা, শ্যাম্পুর মধ্যে ক্লিয়ার, সানসিল্ক, ডাভ, সাবানের মধ্যে লাক্স, ডাভ, লাইফবয়, টয়লেট্রিজ পণ্যের মধ্যে লরিয়াল,বস, গার্নিয়ার, ওয়াশিং পাউডারের মধ্যে সার্ফ এক্সেল, হুইল, রিন, ক্রিম বা বডি লোশনের মধ্যে ভ্যাসলিন, ডাভ, পন্ডস, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, বেবি লোশন জনসন অ্যান্ড জনসন, নুডলসের মধ্যে ম্যাগী, কোল্ড ড্রিংকস বা কোমল পানীয়র মধ্যে কোকাকোলা, পেপসি, স্প্রাইট, ফান্টা, সেভেন আপ, অ্যাটম, অ্যাকুয়াফিনা, চায়ের মধ্যে তাজা, বডি স্প্রের মধ্যে এক্স, অ্যান্টি পারসপিরেন্ট পণ্য হিসেবে রেক্সোনা, পাউডারের মধ্যে পন্ডস, টুথপেস্ট হিসেবে পেপসোডেন্ট, ক্লোজ আপ এবং গাড়ি হিসেবে ফোর্ডের নাম রয়েছে।

ইসরায়েলি পণ্য দাবিতে বিভিন্ন ধরনের ৩৩ টি পণ্যের যে তালিকাটি ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে, সেগুলো ইসরায়েলি পণ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে এই পণ্যগুলোর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কোনোটির সাথে ইসরায়েলের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এই পোস্টে উল্লিখিত তবে পোস্টগুলোতে উক্ত পণ্যগুলোকে ইসরায়েলি পণ্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও কোনো তথ্যসূত্র বা কিসের ভিত্তিতে এ পণ্যগুলোকে ইসরায়েলি পণ্য বলা হচ্ছে সে সম্পর্কিত কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।

প্রথমেই উঠে আসে বাটা, বর্তমানে বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাটা কোম্পানির সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডে । ১৮৯৪ সালে জিলিন শহরে তিন সহোদরের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় । বর্তমানে বিশ্বের ৭০ টির বেশি দেশে ব্যাবসা পরিচালনা করছে বাটা । এর মধ্যে বর্তমান ইসরায়েলের অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ব্যবসা শুরু হয় বাটা প্রতিষ্ঠার প্রায় ৩৪ বছর পর ,১৯২৭ সালে । ১৯৪৮ সালের ১৪ ই মে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা হয়।

এরপর আছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহৃত কিছু জিনিস। 

শ্যাম্পু: ক্লিয়ার, সানসিল্ক ও ডাভ ; ওয়াশিং পাউডার: সার্ফ এক্সেল, হুইল, রিন ; ক্রিম/ বডি লোশন: ভ্যাসলিন, ডাভ, পন্ডস, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ; সাবান: লাক্স, ডাভ, লাইফবয় ; বডি স্প্রে: এক্স

টুথপেস্ট: পেপসোডেন্ট, ক্লোজ আপ ; এন্টি পারসপিরেন্ট: রেক্সোনা। 

ক্লিয়ার, সানসিল্ক ও ডাভ এই তিনটি শ্যাম্পু ও ওয়াশিং পাউডার সার্ফ এক্সেল, হুইল, রিন এবং ক্রিম বা বডি লোশনের মধ্যে ভ্যাসলিন, ডাভ, পন্ডস, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ইত্যাদি পণ্যগুলো ইউনিলিভার কোম্পানির। ইউনিলিভার সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা যায় ১৯৮৩ সালে সানলাইট নামে একটি সাবান প্রস্তুত মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে । পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে নেদারল্যান্ডের কোম্পানি মার্গারিন ইউনির সাথে একীভূত হয়ে ইউনিলিভার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । 

বেবি লোশন: জনসন অ্যান্ড জনসন এটি জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির একটি পণ্য। এই জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানি ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু করে। এর সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের নিউ ব্রান্সউইকে। 

নুডলস: ম্যাগী (Meggi) পণ্যটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে Meggi হিসেবে প্রচার করা হলেও এটির শুদ্ধ বানান Maggi। এই নুডলসটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৮৪ সালে, সুইজারল্যান্ডের উদ্যোক্তা জুলিয়াস ম্যাগীর হাত ধরে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে নেসলে এটিকে কিনে নেয়।

কোল্ড ড্রিংকস বা কোমল পানীয়: কোকাকোলা, পেপসি, স্প্রাইট, ফান্টা, সেভেন আপ, অ্যাটম,অ্যাকুয়াফিনা বর্জনেরও ডাক আসে। মূলত ১৮৯২ সালে কোকাকোলা কোম্পানী আমেরিকান কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতর আমেরিকার আটলান্টার জর্জিয়ায় অবস্থিত। স্প্রাইট ও ফান্টা কোকাকোলারই দুইটি পণ্য।

অপরদিকে পেপসি, সেভেন আপ, অ্যাকুয়াফিনা, অ্যাটম নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই পণ্যগুলো পেপসিকো কোম্পানির তৈরি। পেপসিকো আমেরিকান ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি। এটি ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতর নিউইয়র্কে। 

টয়লেট্রিজ: লরিয়াল,বস, গার্নিয়ার

এই পণ্যগুলোর মধ্যে লরিয়াল, গার্নিয়ার ফরাসি প্রসাধনী নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান লরিয়ালের পণ্য। প্রতিষ্ঠানটি ১৯০৯ সালে ইউরিন শ্যুলার নামে একজন ফরাসি ফার্মাসিস্টের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে । 

চা নিয়ে অনুসন্ধানে Brooke Bond Taaza Tea নামে একটি চা পাতার ব্র্যান্ড খুঁজে পাওয়া যায়। ব্রুক বন্ড ১৮৪৫ সালে আর্থার ব্রুক নামে একজন ব্রিটিশের হাত ধরে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এটি লিপটন টিস অ্যান্ড ইনফিউশন্স এবং ইউনিলিভারের সাথে একীভূত হয়ে যায়।

পাউডার: পন্ডস

এই পাউডারটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৮৪৬ সালে আমেরিকান ফার্মাসিস্ট থেরন টি পন্ড টি টি পন্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই পন্ডসের যাত্রা। বর্তমানে এটিও ইউনিলিভারের সাথে একীভূত হয়ে গিয়েছে।

সবশেষে আছে ফোর্ড নামের গাড়ি । এটিও একটি আমেরিকান কোম্পানি। অনুসন্ধানে উক্ত পণ্যগুলোই কোনোটিরই উৎপাদন ,প্রতিষ্ঠানের সাথে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

Link copied!