করোনাকালীন সময়ে আমদানি ও রপ্তানি অনেক দেশেই বন্ধ ছিল। এছাড়া লেনদেনের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। যার ফলে দেশে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর নিত্য নতুন পদ্ধতিতে দেশে প্রায় ২০০ টি হুন্ডি চক্র বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার করছে।
নতুন কৌশল ব্যবহার হচ্ছে
হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে শুধু প্রথাগত রেমিট্যান্স ও ব্যক্তি পর্যায়ে চুক্তিতে থেকে নেই বরং বিভিন্ন পন্থা ব্যবহার করছেন তারা। এরমধ্যে সীমান্তে ব্যাংকগুলো থেকে এখন টাকা পাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার আড়ালে সীমান্তের ব্যাংকগুলোতে চলে যাচ্ছে টাকা। ওই টাকা নগদ আকারে তুলে নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট হুন্ডি ব্যবসায়ীরা আর সমপরিমাণ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে বিভিন্ন পণ্য। এই প্রক্রিয়ায় অর্থ লেনদেনে ভারত ও মিয়ানমারের তিন কিলোমিটার ভেতরে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় সীমান্তবর্তী এলাকায় দেড় থেকে দুই কি.মি ব্যবধানেই রয়েছে বিভিন্ন টাওয়ার। যার ফলে মিয়ানমারের এমপিটি নেটওয়ার্কের সিম ব্যবহার করা যাচ্ছে বাংলাদেশে বসেই।
সেকেন্ড হোম প্রকল্প
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা অর্থে তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। এ ছাড়া বিদেশ থেকে হুন্ডি হয়ে আসছে রেমিট্যান্সের বিপুল পরিমাণ অর্থ। একইভাবে রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে হুন্ডির চেয়ে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার ভয়াবহ বলে জানান তত্ত্ববধায় সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম হুন্ডি চক্র দেশে ও বিদেশে উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয়। তবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে কারসাজি করে যে অর্থ পাচার হয় সেই অর্থের অঙ্কটা উদ্বেগজনক। আর পাচার করা অর্থের বেশির ভাগই কানাডা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দুবাই চলে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় পাচারকারীরা টাকা পাচারে ওইসব দেশকে বেছে নিচ্ছে।
হুন্ডি সংশ্লিষ্টতায় ২০০ টি গ্রুপ
একশ্রেণির ব্যবসায়ী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার- এমন অন্তত ২০০ ব্যবসায়ী হুন্ডি কারবারে জড়িত। যাদের নামের তালিকা ধরে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সরকারি মুদ্রানীতি অনুসরণ না করে এভাবে অর্থ স্থানান্তরের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সরকারি প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেও সরকার বঞ্চিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যে কোনো উপায়ে হোক অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। অর্থ পাচার বন্ধ করতে না পারলে বিনিয়োগ বাড়ানো দুরূহ হবে। এ জন্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আরও নিবিড় তদারকি প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সামগ্রিক কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশ হুন্ডি
মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে হুন্ডি এখন বড় মাধ্যম। বিদেশে অর্থ শ্রমিকরাও হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সেখান থেকে বিনিময়ের মাধ্যমে দেশের ব্যবসায়ীরা সেসকল দেশে বিনিয়োগ করছে। অথবা অন্য দেশের পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক জরিপে দেখা যায়, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান তার ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। ৩০ শতাংশ আসে সরাসরি প্রবাসী বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে এবং বাকি ৩০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। চলতি বছরে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স এসেছে। সে হিসেবে প্রায় ১৫৩ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্র জানায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিক চক্র হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িত।
চিকিৎসা খাতে হুন্ডির ব্যবহার
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে সর্বাধিক অর্থ পাচার হয় চিকিৎসা খাতে। বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থ হুন্ডিসহ অনানুষ্ঠানিক পন্থায় দেশের বাইরে নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান। এ কারণে বছরে ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ।
৫ শতাংশ মানুষ হুন্ডিতে ভরসা রাখেন
গত ২০১৯ অর্থবছরে মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের উদ্যোগে ‘অ্যাকসেস টু ফিন্যান্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এতে দেশের ৬৪টি জেলার ২ হাজার ৮৭২ জন মানুষ অংশ নেন। তাদের মধ্যে রেমিট্যান্স গ্রহণ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা ৩১৯ জন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট রেমিট্যান্স গ্রহীতার মধ্যে গড় হিসাবে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পান ৪.৯০ শতাংশ মানুষ। এ তথ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সরকারের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায়। ওই প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তদন্ত প্রতিবেদন ও সন্দেহজনক লেনদেনের ৬৭৭টি প্রতিবেদন বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠায় বিএফআইইউ। এর মধ্যে হুন্ডিসংক্রান্ত লেনদেনের প্রতিবেদন ছিল ৬০৯টি। এসব সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে আবারও তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।