ভারতের পাবলো পিকাসোখ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন। তিনি এম.এফ. হুসেন নামেই বেশি পরিচিত। তার চিত্রকর্মে দেশজ ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ এক স্থান অধিকার করেছিল। ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী শিল্প-সংস্কৃতির জগতের অগ্রপথিক মকবুল ফিদা হুসেনের ১০৬ তম জন্মবার্ষিকী আজ।
সমকালীন শিল্পীদের থেকে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র, কারণ তিনি রঙ-তুলি-ক্যানভাসের ভেতরে নিজেকে আটকে রাখেননি। তার প্রতিভার বর্ণচ্ছটায় আলোকিত হয়ে উঠেছিল শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ভাস্কর, বাড়ির নকশাকার এবং চিত্রনির্মাতা।
১৯১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের মুম্বাই শহরের খুব কাছে পান্ধারপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় কিছুদিন মাদরাসায় পড়েছিলেন তিনি। ২০ বছর বয়সে মুম্বাইয়ের জে জে স্কুল অব আর্টেসে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। বেশিরভাগ সময় ফুটপাতে, রেলস্টেশনে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন সিনেমার হোর্ডিংয়ের কাজ পেলেন। এই কাজ শেখার পর মকবুল ফিদা বিরাটাকৃতির সিনেমার পোস্টার আঁকতে শুরু করেন।তার আাঁকা পোস্টার আলাদাভাবে নান্দনিক মাত্রায় উত্তীর্ণ হয়ে ওঠে।
নিজস্ব মহিমায় ভাস্বর শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন সফল হয়েছিলেন স্বতন্ত্র একটি জীবনধারা গড়ে তুলতে। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লম্বা তুলি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। যেমনটা ফরাসী শিল্পী অঁরি মাতিস তাঁর লম্বা লাঠির ডগা দিয়ে শিল্প জগতে রাজত্ব করতেন, বা স্প্যানিশ পরাবাস্তব শিল্পের ক্ষ্যাপা রাজা শিল্পী সালভাদর দালিও তাঁর যাদুর কাঠির মত লম্বা তুলি নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সারা বিশ্বময়।
চল্লিশ দশকের শেষের দিকে মকবুল ফিদা হুসেন চিত্রশিল্পী হিসাবে প্রথম পরিচিতি লাভ করেন। তার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে সু্ইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে। পরবর্তীতে তার চিত্রকলা ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৬৬ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী ভুষিত করে। এর পরের বছরই তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘থ্রু দ্য আইজ অব আ পেইন্টার’ নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং ‘গোল্ডেন বেয়ার’ পদক প্রাপ্ত হয়। হিন্দু পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র, হিন্দু দেবী তার প্রিয় বিষয় ছিল। এছাড়া বিষয় হিসেবে নারী, ঘোড়া তার ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে। এছাড়া তার পরিচালিত ‘গজ গামিনী’ চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত মূল ভূমিকায় অভিনয় করেন।
১৯৭১ সালে পাবলো পিকাসো মকবুল ফিদা হুসেন কে সাও পাওলো বাইয়িনিয়্যাল এ আমন্ত্রণ জানান । ১৯৭৩ সালে মকবুল ফিদা পদ্ম ভূষণ পুরস্কার এবং ১৯৮৬ সালে রাজ্য সভায় মনোনয়ন পান । তিনি ১৯৯১ সালে পদ্ম বিভূষণ পুরস্কার পান ।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর হাতে ফিদা হুসেন নানাভাবে হযরানির শিকার হয়েছেন। তার আঁকা দেবী সরস্বতীর নগ্ন প্রতিকৃতি নিয়ে ওইসব সংগঠন হয়ে ওঠে মারমুখো।
১৯৯৮ সালে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মুম্বাইয়ে তার বাড়িতে চড়াও হয়ে বেশ কিছু ছবি নষ্ট করে ফেলে। দেওয়া হয় হত্যার হুমকি। ২০০৬ সালে দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই চিত্রশিল্পিী। ২০১০ সালের কাতারের আমীরের প্রস্তাবে রাজির হয়ে সেদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা শিল্পী।
২০১১ সালের ৯ জুন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে রয়াল ব্রুম্পটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই চিত্রশিল্পী।