নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার অর্ধশতক বছর পেরিয়েছে। সুবর্ণজয়ন্তী পার করা বাংলাদেশ কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে পাকিস্তান থেকে তা নিয়ে হিসাবনিকাশ করতে বসেছেন অনেকেই। শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট করে পূর্ব পাকিস্তানকে লুটে নিয়ে নিজেদের অর্থনীতি সাজানো পশ্চিম পাকিস্তান এখন ৫০ বছর বাদে কি অবস্থায় আছে সেটা বিশ্লেষণেরই বিষয়।
একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে একটা স্বাধীন দেশকে সাজিয়ে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার পথটা অনেকটা কঠিনই ছিল। সেই সব কঠিন বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজ সোনার বাংলা এগিয়ে গেছে অনেকটা। পিছে ফেলেছে সাবেক শোষক পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান পাকিস্তান দেশকে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
ভিন্ন একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখার শুরু যে ছয় দফা থেকে সেই ছয় দফায় অর্থনৈতিক শোষণ থেকে পূর্ব বাংলাকে রক্ষা করার চেষ্টাই ছিল সবচেয়ে বেশি। আর্থিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয় এনেছিল, পেয়েছিল ধ্বংস ও রক্তে ভেজা এক দেশ। হার মেনেছিল পূর্ব বাংলাকে লুটে নিজেদের অর্থনীতি সাজানো পশ্চিম পাকিস্তান।
এতটা সময় পেরিয়ে দেখা যায়, পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই।
দীর্ঘদিন ধরে চলা টালমাটাল রাজনৈতিক অবস্থা ভেঙে দিয়েছে দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে।
স্বাধীনতার সময়কার ও বর্তমানের মুদ্রামান খেয়াল করলেই বুঝা যায়, ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি দেশ সাজিয়ে এখন বাংলাদেশ অনেকটা পিছে ফেলে দিয়েছে পাকিস্তানকে।
স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের ১০০ রুপির মান ছিল বাংলাদেশের ১৬৫ টাকার সমান। এখন ৫০ বছর পর সেই চিত্র ঠিক তার উল্টো। রুপির চেয়ে টাকার মান বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশের ১০০ টাকার জন্য এখন পাকিস্তানে ২৩৬ রুপির বেশি খরচ করতে হবে। অন্যদিকে মার্কিন ডলারের বিপরীতেও পাকিস্তানি রুপির অবস্থা করুণ। এক ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রা বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ২৫০ রুপিতে। অন্যদিকে এক ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকায় দিতে হবে ১০৬ টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে ডলারের বিনিময় হারে নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে নেয় পাকিস্তান সরকার। এরপর থেকে দ্রুত নামতে থাকে পাকিস্তানি রুপির মান। আইএমএফ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেয়ার পরও পাকিস্তান নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেনি। অর্থদাতা সংস্থাটি এরপর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, শর্ত পূরণ করতে না পারলে নতুন করে কোনো ঋণ দেওয়া হবে না পাকিস্তানকে। আইএমএফের অভিযোগ, তাদের শর্ত পূরণ না করে দেশটির সরকার কেবল ঋণ নিতে চায়।
দেশটির মুদ্রার মান পতনের গতি কমাতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে হস্তক্ষেপে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাগ্রহই মূলত রুপির নিম্নমুখী প্রবণতার সূচনা করেছিল বলে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।
লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, চলতি হিসাব ও বাণিজ্য ঘাটতি, প্রায় তলানিতে ঠেকা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন মিলিয়ে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ। বর্তমান রিজার্ভ ৬০০ কোটি ডলারেরও নিচে নেমে গিয়েছে। দেশটিতে গত বছরের ভয়াবহ বন্যা ও সাম্প্রতিক বৈদ্যুতিক বিপর্যয়ও অর্থনীতিতে অনেকটা প্রভাব ফেলেছে।
এসব কারণে পাকিস্তানের স্থানীয় মুদ্রা বাজারে চাপ পড়ছে।আমদানিমূল্য পরিশোধে ডলারের বাড়তি চাহিদা পাকিস্তানি মুদ্রার ক্রমাগত অবমূল্যায়নে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবসায়ীরা। সেই তুলনায় অনেকটাই স্বস্তিতে রয়েছে বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার।
বাধ্য হয়ে খরচ কমাতে মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বেতন ১৫ শতাংশ এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১০ শতাংশ কমাতে নতুন প্রস্তাব আনা হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের সদস্য সংখ্যা ৭৮ জন থেকে ৩০ জনে নামিয়ে আনার সুপারিশও করা হয়েছে।
বলা যায়, রাজনৈতিক দিক থেকেও পাকিস্তানের চেয়ে অনেকটা ভালো অবস্থায় আছে বাংলাদেশ।
মুদ্রার দামের ব্যাপক পতনের কারণে শুধু আর্থিক সংকট নয়, খাদ্যদ্রব্যমূল্যও অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে পাকিস্তানে। কোনো কোনো জায়গায় এক প্যাকেট আটা ৩ হাজার রুপিতেও বিক্রি হচ্ছে বলে দেশটির গণমাধ্যমে দেখা যায়।
বাংলাদেশ এখনো অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে অনেকটা ভালো অবস্থায় আছে। এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির দিকে। অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়টার ধাক্কা সামলে নিতে সব মিলিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জন্মের সূবর্ণজয়ন্তী পার করা ছোট্ট বাংলাদেশ। অন্য দিকে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রশ্নই জাগে, অস্থির-ভঙ্গুর রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পাকিস্তান কি শ্রীলঙ্কার পথ ধরে হাঁটছে?