হুমায়ূন আহমেদের লেখায় জাহানারা ইমাম

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২৭, ২০২৩, ০১:৪২ এএম

হুমায়ূন আহমেদের লেখায় জাহানারা ইমাম

সংগৃহীত ছবি

জাহানারা ইমাম: তিনি

রাত নয়টার মতো বাজে। আমি কী যেন লিখছি। হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘বাবা, খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।’

আমি দেখলাম, আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায় চকচক করছে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। বিখ্যাত মানুষেরা যে আমাকে একেবারেই টেলিফোন করেন না, তা তো না। মেয়ে এত উত্তেজিত কেন?

‘বাবা, তুমি কিন্তু আবার বলতে বলবে না যে তুমি বাসায় নেই। তোমার বিশ্রী অভ্যাস আছে, বাসায় থেকেও বলো বাসায় নেই।’

আমি বললাম, ‘টেলিফোন কে করেছে, মা?’

আমার মেয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘জাহানারা ইমাম।’

‘এই নাম ফিসফিস করে বলছ কেন? ফিসফিস করার কী হলো?’

‘বাবা, উনি যখন বললেন তাঁর নাম জাহানারা ইমাম, তখন আমি এতই নার্ভাস হয়ে গেছি যে তাঁকে স্লামালিকুম বলতে ভুলে গেছি।’

‘বিরাট ভুল হয়েছে। যা-ই হোক, দেখা যাক কী করা যায়।’

আমি টেলিফোন ধরলাম এবং বললাম, ‘আমার মেয়ে আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গেছে, এ জন্য সে খুব লজ্জিত। আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। সে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।’

ওপাশ থেকে তাঁর হাসির শব্দ শুনলাম। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনাকে টেলিফোন করেছি কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে।’

‘বলুন।’

‘আপনি রাগ করুন বা না করুন, কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে।’

‘আমি শঙ্কিত হয়ে আপনার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।’

‘আপনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পত্রিকায় লেখেন কেন? আপনার মতো আরও অনেকেই এ কাজটি করে। কিন্তু আপনি কেন করবেন?’

তিনি কথা বলছেন নিচু গলায়, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। কোনো আড়ষ্টতা নেই।

আমি হকচকিয়ে গেলাম। আক্রমণ এদিক থেকে আসবে, ভাবিনি। তবে পত্রিকায় লেখা দেওয়ার ব্যাপারে আমার কিছু যুক্তি আছে। খুব যে দুর্বল যুক্তি, তা-ও না। যুক্তিগুলো তাঁকে শোনালাম। মনে হলো, এতে তিনি আরও রেগে গেলেন। 

কঠিন গলায় বললেন, ‘আপনার মিসির আলীবিষয়ক রচনা আমি কিছু কিছু পড়েছি, আপনি যুক্তি ভালো দেবেন, তা জানি। কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে যুক্তি শুনতে চাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে, ওদের পত্রিকায় লিখে ওদের হাত শক্তিশালী করবেন না। আপনি একজন শহীদ পিতার পুত্র। “তুই রাজাকার” স্লোগান আপনার কলম থেকে বের হয়েছে। বলুন আর লিখবেন না।’

আমি সহজে প্রভাবিত হই না। সে রাতে হলাম। বলতে বাধ্য হলাম, ‘আপনাকে কথা দিচ্ছি আর লিখব না। এখন বলুন, আপনার রাগ কি কমেছে?’

একেবারে কিশোরী গলায় তিনি অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার মেয়েকে বলবেন, লম্বা চুল আমার খুব প্রিয়। আমি যখন ওর বয়সী ছিলাম, তখন আমার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল ছিল। ছবি আছে। আমি আপনার মেয়েকে ছবি দেখাব। চুল কেটে ছোট করতে হয়েছে ক্যানসারের জন্য।

তিনি হেসে ফেললেন। বাচ্চা মেয়েদের একধরনের হাসি আছে—কুটকুট হাসি, বড়দের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে যে-হাসিটা তারা হাসে, সেই হাসি।

আমি বললাম, ‘আমি সব সময় লক্ষ করেছি, আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলেন। নিজেকে খুব দূরের মানুষ মনে হয়। দয়া করে আমাকে তুমি করে বলবেন।’

তিনি বললেন, ‘আচ্ছা বলব। এখন থেকে বলব।’

তিনি কিন্তু আমাকে ‘তুমি’ কখনোই বলেননি। যতবারই মনে করিয়ে দিয়েছি, ততবারই বলেছেন, ‘হ্যাঁ, এখন থেকে বলব।’ কিন্তু বলার সময় বলেছেন ‘আপনি’। হয়তো আমাকে তিনি কখনোই কাছের মানুষ মনে করেননি।

তাঁর অনেক কাছের মানুষ ছিল আমার মা। আমার ছোট ভাই জাফর ইকবাল। জাফর ইকবালের উল্লেখ তাঁর লেখাতে পাই। ব্যক্তিগত আলাপেও জাফর ইকবালের প্রসঙ্গে তাঁকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছি। শুধু আমার ব্যাপারেই একধরনের শীতলতা। হয়তো তাঁর ধারণা হয়েছিল, যে-মহান আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন, আমি সেই আন্দোলন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি। যে ১০১ জনকে নিয়ে ‘ঘাতক দালাল নিমূ‌র্ল কমিটি’র আদিযাত্রা, আমি সেই ১০১ জনের একজন। অথচ পরে আমার আর কোনো খোঁজ নেই। কাজেই আমার ভূমিকায় অস্পষ্টতা তো আছেই। তিনি আমার প্রতি শীতল ভাব পোষণ করতেই পারেন। সেটাই স্বাভাবিক।

আরেক দিনের কথা, তিনি টেলিফোন করেছেন। গলার স্বর অস্পষ্ট। কথা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘আপনার শরীর কি খারাপ করেছে?’

তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘শরীর আছে শরীরের মতোই। আপনাকে একটা ব্যাপারে টেলিফোন করেছি।’

‘বলুন, কী ব্যাপার।’

‘এই যে একটা আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এতে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আমাকে চলতে হচ্ছে মানুষের চাঁদায়। আপনি প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দেবেন।’

‘অবশ্যই দেব।’

‘আমি একজনকে পাঠাচ্ছি। এ মাসের চাঁদা দিয়ে দিন।’

‘জি আচ্ছা, কত করে দেব?’

‘আপনি আপনার সামর্থ্যমতো দেবেন। মাসে দুই হাজার করে দিতে পারবেন?’

‘পারব।’

একজন এসে চাঁদা নিয়ে গেল। পরের দুই মাস কেউ চাঁদা নিতে এল না। আমার একটু মন খারাপ হলো।

মনে হলো, হয়তো সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমার কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হবে না। তৃতীয় মাসে তিনি টেলিফোন করে বললেন, ‘কী ব্যাপার, আপনি আপনার চাঁদার টাকা দিচ্ছেন না কেন?’
আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘কেউ তো নিতে আসেনি।’

‘আমার এত লোকজন কোথায় যে পাঠাব! আপনি নিজে এসে দিয়ে যেতে পারেন না? আপনি তো এলিফ্যান্ট রোডেই থাকেন। দুই মিনিটের পথ।’

‘আমি আসছি। ভালো কথা, আপনার সঙ্গে রাগারাগি করার মতো একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি এসেই কিন্তু রাগারাগি করব।’

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘এসে নিই, তারপর বুঝবেন।’

‘না, এখনই বলুন।’

‘আমার বড় মেয়ে নোভার ছিল মাথাভর্তি চুল। আপনি হচ্ছেন তার আদর্শ। আপনার মাথার ছোট ছোট চুল তার খুব পছন্দ। সে আপনার মতো হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে তার মাথার সব চুল কেটে ফেলেছে।’

‘সত্যি?’

‘বাসায় আসুন। বাসায় এসে দেখে যান।’

একেবারে কিশোরী গলায় তিনি অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার মেয়েকে বলবেন, লম্বা চুল আমার খুব প্রিয়। আমি যখন ওর বয়সী ছিলাম, তখন আমার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল ছিল। ছবি আছে। আমি আপনার মেয়েকে ছবি দেখাব। চুল কেটে ছোট করতে হয়েছে ক্যানসারের জন্য। কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়ে যাচ্ছিল। কী আর করব?’

তিনি একবার আমার বাসায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমার মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। তাঁর গল্প করতে ইচ্ছা করছে। গাড়ি পাঠিয়ে তাঁকে আনালাম। বাসায় আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। গ্রহ যেমন সূর্যকে ঘিরে রাখে, আমার মেয়েরাও তাঁকে সেভাবে ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়ল। তিনি তাদের বললেন তাঁর শৈশবের কথা। আমি আসরে যোগ দিতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, ‘আপনি আসবেন না। এই আসরে আপনার প্রবেশাধিকার নেই।’

অন্যান্য ফ্ল্যাটে খবর চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা আসছে। তারাও গল্প শুনতে চায়।

আমার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়ল, অতি সম্মানিত এই মানুষটিকে সে কী খাওয়াবে? তিনি তো কিছুই খেতে পারেন না।

তিনি আমার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন, শুধু মুখে যাবেন না। কিছু খাবেন। পাকা পেঁপে থাকলে ভালো হয়।

ঘরে পাকা পেঁপে নেই। আমি ছুটলাম পাকা পেঁপের সন্ধানে। লিফট থেকে নামতেই এক ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘জানেন, আমাদের এই ফ্ল্যাটের কোনো এক বাড়িতে জাহানারা ইমাম এসেছেন।’

আনন্দে আমার মন দ্রবীভূত হলো। এই মহীয়সী নারী কত অল্প সময়ে মানুষের হৃদয় দখল করে নিয়েছেন! 

তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে দেন আসাদুজ্জামান নূর।

বাসায় তখন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজছে। আমার মেয়েরা জন ডেনভারের গান শুনছে ‘রকি মাউন্টেন হাই, কলোরাডো’। সঙ্গে সঙ্গে গান বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। 

আমার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, আন্দোলন এখন কে এগিয়ে নিয়ে যাবে? আমি তাঁকে বললাম, দ্বিতীয় জাহানারা ইমাম আমাদের নেই। জাহানারা ইমাম দুটা-তিনটা করে জন্মায় না। একটাই জন্মায়। তবে কেউ-না-কেউ এগিয়ে আসবেই। অপেক্ষা করুন।

মা জায়নামাজে বসলেন।

আর আমি একা-একা বসে রইলাম বারান্দায়। একধরনের শূন্যতাবোধ আমার ভেতর জমা হতে থাকল। কেবলই মনে হতে লাগল, একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। কী পরিমাণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এই মানুষটির প্রতি আমার ছিল, তা তাঁকে জানানো হয়নি। আমার একটাই সান্ত্বনা, মৃত্যুর ওপাশের জগৎ থেকে আজ তিনি নিশ্চয়ই আমার বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করতে পারছেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি সব সময়ই তাঁর পাশে ছিলাম। যে কদিন বেঁচে থাকব, তা-ই থাকব। বঙ্গজননীর পাশে তাঁর সন্তানেরা থাকবে না, তা কি কখনো হয়?

বাংলার পবিত্র মাটিতে তাঁর পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের এই সংবাদে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলার হৃদয়ে তিনি জ্বেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। ঝড়-ঝাপটা যত প্রচণ্ড হোক না কেন, সেই শিখা জ্বলতে থাকবে। কী সৌভাগ্য আমাদের, তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে!

রচনাকাল: ১৪ এপ্রিল ২০০১

Link copied!