পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে বলা হয় কায়েদে আজম এবং বাবায়ে মিল্লাত (জাতির পিতা)। যে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানেরে সৃষ্টি সেই ধর্মে প্রবল অনীহা ছিল এই নেতার। পারিবারিক জীবনেও ছিলেন প্রবল স্ববিরোধী। বলা যায়, স্ববিরোধীতায় ভরা ছিল তার জীবন।
একবার একজন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে বলেছিলেন কোন এক মসজিদে নামাজ পড়তে। সেসময় জিন্নাহ তাকে উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি জানেন না কিভাবে নামাজ পড়তে হয়। জিন্নাহ সম্পর্কে এই বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছেন প্রখ্যাত লেখক খালিদ লতিফ গৌবা।
খালিদ লতিফ তার এক লেখায় লিখেছেন, তিনি জিন্নাহকে কোনো একটা মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। জবাবে এই মুসলিম লীগ নেতা বলেছিলেন, ‘আমি জানি না কীভাবে নামাজ পড়তে হয়।’ তখন গৌবা বলেছিলেন, ‘মসজিদে অন্যরা যা করবে, আপনিও তাদের দেখাদেখি সেটাই না হয় করবেন।’
জিন্নাহর দিন শুরু হতো সকাল সাড়ে আটটার দিকে সুগন্ধী কিউবান সিগারের সঙ্গে। একটা বড় টেবিলে ফাইলবন্দি কাগজপত্রের স্তূপের পাশে থাকত ক্রেভিন নামের সিগারেটের বাক্স। তার সুগন্ধে ঘর সবসময়ে ম ম করত।
জিন্নাহ নিজেকে মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতা মনে করলেও কখনো ধর্মীয় নেতা হতে চাননি। সে কারণে তাকে বেশ কয়েকবার ধর্ম-সঙ্কটেও পড়তে হয়েছে। এখানে একটা বিষয় স্মরণ রাখা যেতে পারে যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্বপুরুষরা ছিলেন ইসামইলিয়া খোঁজা সম্প্রদায়ের পরে তারা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তবে ধর্মে মতি ছিল না তার।
জিন্নাহ যে ধর্মকে কেবল রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় অনেক। ১৯৪০ এ যখন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক তার বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব উত্থপান করেন, সেখানে উল্লেখ ছিল যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একাধিক রাষ্ট্র গঠনের কথা। কিন্তু জিন্নাহ সেটাকে কলমের খোঁচায় মুদ্রণ প্রমাদ হিসেবে উল্লেখ করে একটি মাত্র রাষ্ট্রের ধারণা হাজির করেন। যদিও এর অনেক আগে থেকেই জিন্নাহ ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দুই আলাদা ধর্মের মানুষদের ভিত্তিতে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবী করে আসছিলেন। তবে অনেকেই এই দ্বিজাতি তত্ত্ব সমর্থন করলেও এবং এর তৎকালীন যৌক্তিকতা থাকলেও পাকিস্তানের জন্মের মাত্র ২৩ বছরের মাথায় তা ভেঙে গিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে জিন্নাহ নয় শেরে বাংলাই সঠিকি ছিলেন। জিন্নাহ কেবল তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ইসলামকে ব্যবহার করেছিলেন।
ব্যক্তি জীবনে জিন্নাহ কেমন ছিলেন? স্ববিরোধী। অবশ্যই স্ববিরোধী। প্রেম ছিল তার রতনবাঈ পেটিটের বা রতি পেটিটের সঙ্গে। জিন্নাহ তখন ৪০ বছরের এবং রতি পেটিটের ১৬।
রতি পেটিটের বাবা স্যার দিনশা পেটিট একবার তার কিছু বন্ধু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহতে তার বাসায় দাওয়াত করেছিলেন। সেখানে একদিন খাওয়ার টেবিলে আলাপ উঠলো দুই ধর্মের বিয়েকে দিনশা পেটিট কিভাবে দেখেন। স্যার দিনশা মন্তব্য করেছিলেন যে, দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহসূত্রে মেলবন্ধন হলে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করতে সুবিধাই হবে।
গবেষক-লেখক শীলা রেড্ডির জবানীতে বিবিসি বাংলা লিখছে, ‘‘মুম্বাইয়ের সবথেকে বড় ধনীদের মধ্যে একজন স্যার দিনশা পেটিট সকালের নাশতা খেতে বসেছিলেন। খাবার টেবিলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন নিজের প্রিয় খবরের কাগজ 'বম্বে ক্রনিক্যাল'।
খবরের কাগজে আটের পাতায় পৌঁছে একটা খবরে চোখ যেতেই কাগজটা তাঁর হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। তারিখটা ছিল ২০শে এপ্রিল, ১৯১৮।
সংবাদটা ছিল স্যার দিনশার কন্যা লেডি রতিকে আগের দিন সন্ধ্যায় বিয়ে করেছেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। লেডি রতির পুরো নাম ছিল রতনবাই পেটিট। ঘটনার শুরুটা হয়েছিল আরও বছর দুয়েক আগে। স্যার দিনশা নিজের বন্ধু আর ব্যারিস্টার মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
সেখানে দিনশার ১৬ বছরের কন্যা লেডি রতিও ছিলেন। সেই সময়ের মুম্বাইয়ে মিস রতির সৌন্দর্য রীতিমতো চর্চার বিষয় ছিল। আর জিন্নাহ তখন ভারতীয় রাজনীতির শিখরের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন।
মি: জিন্নাহর বয়স তখন প্রায় ৪০।
কিন্তু দার্জিলিংয়ের বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া আর নৈ:শব্দ এমনই যাদু দেখালো যে লেডি রতি ও মি: জিন্নাহ একে অন্যের প্রেমে পড়ে গেলেন। দার্জিলিং ভ্রমণের সময়েই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্যার দিনশা পেটিটের কাছে তাঁর কন্যার পাণি প্রার্থনা করেন, প্রস্তাব দেন তার মেয়েকে বিয়ে করার।
'মিস্টার এন্ড মিসেস জিন্নাহ - দা ম্যারেজ দ্যাট শুক ইন্ডিয়া'
বইটির লেখিকা শীলা রেড্ডির কথায়, "দার্জিলিংয়েই একদিন নৈশাহারের সময়ে মি: জিন্নাহ প্রশ্ন করেছিলেন দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহ নিয়ে স্যার দিনশার কী মতামত।"সঙ্গে সঙ্গেই মিস রতি'র বাবা উত্তর দিয়েছিলেন যে দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহসূত্রে মেলবন্ধন হলে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করতে সুবিধাই হবে।
এর থেকে পছন্দের উত্তর স্বয়ং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও বোধহয় দিতে পারতেন না।
তাই মুহুর্তের মধ্যে মি: জিন্নাহ ফের মুখ খুললেন, স্যার দিনশাকে জানালেন যে তিনি তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে চান।
তবে এই প্রস্তাবে সাংঘাতিক উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন স্যার দিনশা। উত্তেজনা এতটাই ছিল যে অতিথিকে সেই মুহুর্তে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন তিনি।
মি: জিন্নাহ অনেক চেষ্টা করেও স্যার দিনশার মত বদলাতে পারেননি।
দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহ বন্ধন হলে যে বন্ধুত্ব আর ঐক্য দৃঢ় হবে, স্যার দিনশার ওই তত্ত্ব প্রথম পরীক্ষাতেই ব্যর্থ হয়ে গেল।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে কথা বলেননি স্যার দিনশা। আর মেয়ে লেডি রতির ওপরেও নির্দেশ জারি হলো- যতদিন তিনি দিনশার বাড়িতে আছেন, ততদিন জিন্নাহর সঙ্গে কোনোভাবে দেখা করতে পারবেন না।
সেখানেই শেষ নয়। কোর্ট থেকেও আদেশ বের করালেন স্যার দিনশা যেন লেডি রতি প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মি: জিন্নাহ যাতে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা না করতে পারেন।
এত কিছু করেও রতি আর জিন্নাহর লুকিয়ে দেখা করা বা একে অন্যকে চিঠি লেখা থামাতে পারেননি স্যার দিনশা পেটিট।
শীলা রেড্ডি তাঁর বইয়ে বলছেন, "একবার রতিকে একটি চিঠি পড়তে দেখে ফেলেন দিনশা। চিৎকার করে ওঠেন তিনি, এটা নিশ্চয়ই জিন্নাহর চিঠি। রতিকে ধরার জন্য খাবার টেবিলের চারদিকে দৌড়াতে থাকেন স্যার দিনশা, যাতে হাতেনাতে ধরে ফেলা যায় জিন্নাহর চিঠিটা। কিন্তু মেয়েকে ধরতে পারেননি তিনি।"
স্যার দিনশা অসম্ভব জেদি ছিলেন, কিন্তু অসমবয়সী এই প্রেমিক যুগলের জেদ যে আরও বেশী, সেটা দিনে দিনে বেশ বুঝা যেতে লাগল।
তবে দুই পক্ষই কিছুটা মাথা ঠান্ডা রেখে চুপচাপ রতির ১৮ বছর বয়স পার হওয়া অবধি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আরেক জীবনীকার অধ্যাপক শারিফ আল মুজাহিদ বলছেন, "১৯১৮ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি লেডি রতি ১৮-তে পা দিলেন। আর সেদিনই একটা ছাতা আর এক জোড়া পোষাক নিয়ে পিতৃগৃহ ত্যাগ করলেন তিনি।"
রতিকে জামিয়া মসজিদে নিয়ে গেলেন জিন্নাহ। ইসলাম ধর্মান্তরিত করে পরের দিন, ১৮ই এপ্রিল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর লেডি রতির নিকাহ সম্পন্ন হলো।
মিস রতি ও মি: জিন্নাহকে নিয়ে একটি বইয়ের লেখক খওয়াজা রাজি হায়দার বলছেন, "জিন্নাহ তখন ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যদি তিনি সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে করতেন, তাহলে সম্ভবত তাঁকে কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করতে হতো। সেজন্যই তিনি ইসলামী মতে বিয়ে করেছিলেন আর রতিও রাজি হয়েছিলেন এতে।"
নিকাহনামায় ১০০১ টাকা মোহরের উল্লেখ ছিল, কিন্তু জিন্নাহ রতিকে উপহার দিলেন এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা। সেসময়ে সেটা বিশাল অঙ্কের টাকা।
২৪ বছরের ছোট একটি মেয়ের সঙ্গে জিন্নাহর বিবাহ সেই সময়ে ভারতীয় সমাজের এক নম্বর গসিপে পরিণত হয়েছিল। সামাজিক আলোড়নও ফেলেছিল সেই ঘটনা।’’
জিন্নাহ তো রতনবাঈকে বিয়ে করেছিলেন ধর্মান্তরিত করে। কিন্তু সেই তিনিই তার কন্যা দিনা অন্য ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করায় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।
জিন্নাহ নিজে প্রেমের বিয়ে করলেও নিজ কন্যার প্রেমকে মেনে নেননি। এমন আরো অনেক স্ববিরোধীতা ছিল তার। সিগারেট অ্যালকোহল পানের কথাও তো আজ অনেকের জানা।
হয়তো সেকারণেই জিন্নাহর শরীরে বাসা বেঁধেছিল এক মরণ রোগ। তার চিকিৎসক ডা. প্যাটেল এক্সরে প্লেটে চোখ রেখেই দেখতে পেয়েছিলেন ফুসফুসে ছোপছোপ দাগ। কিন্তু তিনি গোপন রেখেছিলেন ব্যাপারটা।
১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জিন্নাহকে কোয়েটা থেকে ভাইকিং বিমানে চাপিয়ে করাচী নিয়ে আসা হয়। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ওজন তখন মাত্র ৪০ কিলোগ্রাম। যে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে গভর্নর হাউসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, মাঝপথে সেটার পেট্রল শেষ হয়ে যায়। পরে তার সামরিক সচিব অনেক চেষ্টা করে ঘণ্টাখানেক পরে একটা অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। অ্যাম্বুলেন্সেই জিন্নাহর পালস কমে আসছিল। সেই রাতেই তিনি মারা যান।