পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল আর সোশ্যাল মিডিয়া এখন সয়লাব সদ্য বরখাস্ত হওয়া তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে নিয়ে। খবরের ভাষায় যাকে বলে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ এখন মুরাদ হাসান। নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে তার পদচ্যুতির পর পথে-ঘাটে, হাটে-মাঠে, চায়ের দোকান, অফিস-আদালতের আড্ডায় এখন তিনি আলোচনার কেন্দ্রে।
আমি নিজে অফিসে যাতায়াতের পথে ঢাকার সাধারন মানুষদের সাথে কথা বলে দেখেছি, এই প্রতিমন্ত্রীর নাম আগে তারা সেভাবে শোনেননি! অথচ এখন তাকে চেনেন না, এমন মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়া ভার! এখন তিনি তুমুল আলোচিত একজন। প্রযুক্তির চরমতম উৎকর্ষের এই যুগে এমন আলোচিত ব্যক্তিকে নেটিজেনরা বলে থাকেন ভাইরাল! ডা. মুরাদ হাসান এখন প্রকৃত অর্থেই ভাইরাল একজন!
প্রতিমন্ত্রীর পদ এরমধ্যেই খুইয়েছেন মুরাদ হাসান। পদের পাশাপাশি তিনি তার হস্ত মানে দলীয় অবস্থানও হারিয়েছেন। তিনি যেসব কীর্তি করেছেন এবং গড়েছেন, তাতে তার হস্ত-পদ দুটিই যে হারানোর কথা, সেটি ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
ক্ষমতা এ দেশে লোভনীয় এক জিনিস। কথায় বলে, ক্ষমতা পেলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। ছোট ক্ষমতা ছোট অপরাধের জন্ম দেয়, বড় ক্ষমতা জন্ম দেয় বড় অপরাধের। ক্ষমতা পাওয়ার পর এ দেশে নিজেকে স্বচ্ছ-সংযত রেখেছেন, এমন নেতা বিরল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসৎ পথে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকা বানানো। বিভিন্ন সরকারের সময়ে আমরা দেখেছি, একদিন যিনি রাস্তার লোক হিসেবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, ক্ষমতাসীন হয়ে যাওয়ার কারণে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন! তখন তারা ধরাকে (পৃথিবীকে) সরা (মাটি হাড়িপাতিলের ঢাকনা) জ্ঞান করেছেন!
শুধু বড় ক্ষমতাই নয়, পাড়া-মহল্লার দলীয় পদ-পদবী পেলেও এক শ্রেণির ক্ষমতাবান তাদের দাপট দেখাতে শুরু করেন। এখন যুগটা এমন পড়েছে যে, কী শহর, কী তৃণমূল— মুরোদ বা দাপট না দেখালে যেন চলেই না!
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, ক্ষমতাকেন্দ্রীক এই মুরোদ তাদেরকে কে বা কারা করে দিয়েছে? উত্তর একটাই, ক্ষমতাসীন দল। তবে এই সংকট থেকে তখনই বেরিয়ে আসা যাবে যখন দলের মধ্যে বিশেষ স্বচ্ছ শক্তিশালী মনিটরিং সেল থাকবে, অপরাধের বা দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে, জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা থাকবে, সর্বোপরি নেতামন্ত্রীকে সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক হতে হবে। আর না হলে, পদাধিকারী যে সুযোগ পেলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ধরাকে সরা জ্ঞান করবেন, লুটপাট করবেন, এতে অবাক হওয়ারও আসলে কিছুই নেই। এক মুরাদের মুরোদ ফুরাবে ত আরেক মুরাদ ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত দাপট চালিয়ে যাবেন।
কি কাকতালীয় এক ঘটনা! প্রতিমন্ত্রীর নামও মুরাদ। আরবিতে মুরাদ মানে ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্ষমতা, সামর্থ্য, শক্তি, পৌরুষ ইত্যাদি। সত্যি সত্যি তিনি তার মুরদের যতটুকু সম্ভব তারও চেয়ে বেশি মুরদের (ক্ষমতা) চর্চা (অপচর্চা) করেছেন। যা মন চেয়েছে, তা-ই তিনি করে গেছেন অবলীলায়! নিজের নামের সার্থকতার প্রমাণ দিতে পৌরুষ প্রদর্শনে সামান্য কার্পণ্যও তিনি করেননি। তা-ও আবার অগোচরে নয়, প্রকাশ্যে! একটি দুটি ঘটনা নয়; অসংখ্য বিতর্কিত এবং অগ্রহণযোগ্য কীর্তি করে তিনি নিজ নামের শক্তিমত্তাই যেন বারবার প্রকাশ করেছেন! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তিনি প্রথম দিকে যখন উল্টাপাল্টা কাণ্ড করেও সেভাবে আলোচিত হতে পারছিলেন না, একটি ঘটনা ঘটানোর পর পরের ঘটনাকে তিনি তাই আরও কীভাবে আলোচিত করা যায়, সেদিকে মনোযোগী হয়েছেন। অর্থাৎ ভাইরাল না হওয়া পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত দেননি।
এ দেশে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় হল ধর্ম। সুশিক্ষিত জনপ্রতিনিধিরা যেখানে সবাই অসাম্প্রদায়িকতার শান্তির বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেখানে প্রথমেই তিনি সেই ধর্মের বিষয়ে বিতর্ক তুলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
এতে মনোযোগ লাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি নারীদের নিয়ে একের পর এক চরম কটুক্তিকর কথা বলে গেছেন। দেশের গৌরবের ইতিহাসের অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানটির আবাসিক ছাত্রী এবং তাদের হল নিয়েও বারংবার আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন।
মিস্টার মুরাদ যে সংগঠন করে এসেছেন, সেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও বিষোদগার করেছেন! এসব করেও যখন তিনি লাইম লাইটে আসতে পারেননি, তখন তিনি মিডিয়ার মডেল বা অভিনেতা অভিনেত্রীদেরকে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে জোরপূর্বক হোটেল উঠিয়ে আনার কথা বলেছেন!
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা নিদেন পক্ষে সৌজন্যতাটুকু পায়। কিন্তু ডা. মুরাদের কাছ থেকে তার ছিটেফোটাও তারা পায়নি কোনোদিন। শুধু মুখ চালিয়েই ক্ষ্যান্ত দেননি তিনি, অনুষ্ঠান মঞ্চে উন্মাতাল নাচতেও দেখা গেছে তাকে! যদিও নাচগানে আপত্তি নেই কারও, কিন্তু সেই নাচগান যদি নিজেকে ভাইরাল করার উদ্দেশ্যে হয়, একজন জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিত্বের সাথে সেটি কোনোভাবেই যায় না।
তার তুলকালাম কাণ্ডে নিজ মন্ত্রনালয়ের কর্তা-কর্মচারিরাও ছিলেন তটস্থ! কিন্তু এ দেশে একজন ক্ষমতাসীন মস্ত্রীকে ঘাঁটায়, এমন সাহস কারইবা আছে! ফলে মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না তাদের। অডিও-ভিডিও ফাঁসে প্রতিমন্ত্রীর পদচ্যুতির পর এখন তারা কথা বলতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, প্রতিমন্ত্রী নিজের মতো একেবারে খামখেয়ালিভাবে চলতেন। কারণে-অকারণে করতেন অশ্রাব্য গালাগালি। গালাগালি করা নাকি ছিল তার মামুলি বিষয়। তাকে কেউ বুঝাতে পারতো না। ভাইরাল হওয়ার নেশা এতটাই চেপে বসেছিল যে ডা. মুরাদ খেই হারিয়ে ফেললেন এক পর্যায়ে। গত কয়েক মাসে তিনি এমনই বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। তার কর্মকাণ্ড সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। কেউ কেউ তাকে লাগাম টানার পরামর্শও দিচ্ছিল বারবার। কিন্তু তিনি ভাইরাল নেশার ঘোর থেকে জাগেননি। তাকে প্রধানমন্ত্রী হয়তো স্নেহ করতেন। কিন্তু তারও মূল্য দেননি ডা. মুরাদ। ফলে ভাইরাস রোগটি তার পা থেকে মাথা অবধি ছড়িয়ে গেল। সেই ভাইরাসই তাকে শেষতক খেয়েও ফেলল!
অ্যানালগ যুগে ‘ভাইরাল’ শব্দটি আগাগোড়াই ছিল আতঙ্কের কারণ। কিন্তু ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মতো ডিজিটাল প্লাটফরম ভাইরালকে দিয়েছে ইতিবাচক এক ভাবমূর্তি। বড় অদম্য নেশা এই ভাইরাসের! একবার যাকে ছুঁয়ে দেয়, তার আর পিছু হটার জো থাকে না বোধ হয়। মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম, চরস, মরফিন, হেরোইন, মারিজুয়ানা, কোকেন, হাসিস, পেথেডিন, ফেনসিডিল কিংবা হালের এলএসডির চেয়েও মারাত্মক নেশা এই ভাইরালের! যদিও করোনাভাইরাস এসে এক অর্থে ‘ভাইরাল’ শব্দটির জনপ্রিয়তায় সামান্য ধস নামিয়ে দিয়েছে। তারপরও ডা. মুরাদদের মতো অনেকেই এখনো ভাইরালেই আস্থা রাখেন। ভাইরালের মর্তবা এ যুগে কীভাবে যেন সবাই বুঝে গেছেন!
শুধু ডা. মুরাদই নন, মন্ত্রিসভার আরও কয়েকজন সদস্য প্রায়ই বেফাঁস কথা বলে প্রতিনিয়ত আলোচনায় থাকতে চান! ভাইরাল হওয়ার নেশার ঘোর তাদেরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। এদেরও ভাইরাল রোগের চিকিৎসা দরকার। নাহলে সরকার ত বটেই, দলের ভাবমূর্তিরও বারোটা বাজবে। সরকারের যে অর্জন, সেগুলোও যাবে জলে।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট